সেক্যুলারিজমঃ ইসলাম ধ্বংসের আঁতুড়ঘর

হাল আমলে আধুনিক রাষ্ট্রের অনুসৃত মতবাদের মধ্যে সেক্যুলারিজম রয়েছে প্রথম কাতারে। সেক্যুলারিজম মানবতার জন্য এক অভিশাপ। অবশ্য ইসলাম ব্যতীত মানবজাতি অন্য যে সকল মতবাদ নিয়ে এগিয়েছে তা অভিশাপ রূপে দেখতে পেয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যান্য মতবাদগুলো ইসলামের বিপরীত স্থানে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত ঐশ্বরিক বিধান ত্যাগের জন্য ইসলাম ও অন্যান্য মানবরচিত বিধানের বৈপরীত্য ও বিরুদ্ধতা সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।

কিন্তু সেক্যুলারিজম এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থায় ইসলাম ও মুসলিম জাতির ধ্বংস সাধন করে যাচ্ছে। সেক্যুলারিজম কর্মপন্থা বুঝতে হলে এর সংজ্ঞা, ইতিহাস ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা প্রয়োজন। অনেকে স্বদেশী সেক্যুলারিজম আর ইউরোপীয় সেক্যুলারিজমের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ফুটিয়ে তুলতে চান। এদেশের বুদ্ধিজীবীগণ দাবী করে থাকেন সেক্যুলারিজম হল— স্বীয় ধর্ম পালনের স্বাধীনতা।

কিন্তু কথা হল, রাষ্ট্র যদি ধর্মকে কেন্দ্র করে গঠিত না হয় তবে স্বাধীনতা দেবার কে?! এ সকল রাষ্ট্র কখনও ধর্মের স্বাধীনতা হরণই করেনি আর স্বাধীনতা দেবে কোত্থেকে! ধর্ম উপর ভিত্তি করে গঠিত রাষ্ট্র অন্য ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিতে পারে। বুদ্ধিজীবীদের এহেন অসাড় বাণী বার বার আলোচনা করার প্রয়োজন নেই। আদতে বাংলাদেশে প্রচলিত সেক্যুলারিজম হল ইউরোপীয় সেক্যুলারিজমের ছায়া।

আরও ভালো ভাবে বললে বলা যায়, ইউরোপে ঝড় হচ্ছে আর এদেশে এখন মেঘ করেছে।এখন সেক্যুলারিজমের সংজ্ঞা বুঝে নেওয়া দরকার। সেক্যুলারিজমের বাংলা প্রতিশব্দ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। সেক্যুলারিজম (Secularism) ল্যাটিন শব্দ Secularis থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ হল বৈষয়িক (Worldly), অস্থায়ী (Temporal), প্রাচীন (Oldage) ইত্যাদি। ড. মাহফুজ পারভেজের মতে সেক্যুলারিজম শব্দটির প্রকৃত অর্থ হল: ইহজগৎ সম্বন্ধীয় প্রশ্নবহির্ভূত। অর্থাৎ, ইহজাগতিকতা। অভিধানের ভাষা সেক্যুলার বা ইহজাগতিকতার মানে,

১. যা ধর্ম বা আধ্যাত্মিক ভাবে পবিত্র বলে বিবেচিত নয়।

২. যা ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নয়।

৩. যা কোনো ধর্ম বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত নয়

৪. এমন সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন, যা ধর্ম বিশ্বাসকে নাকচ করে দেয়।

অন্য কথায় যারা কোনো ধর্মের অন্তর্গত নয়, কোনো ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত নয়, কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নয় এবং পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতার বিরোধী, যারা সেক্যুলারিজম বা ইহজাগতিকতাকে বিশ্বাস ও লালন করে তারাই সেক্যুলার। [১]চেম্বারস ডিকশনারির মতে সেক্যুলারিজম হল— এমন এক বিশ্বাস যার মতে রাষ্ট্রীয় নীতি, শিক্ষা ইত্যাদি সবকিছু ধর্মমুক্ত থাকবে। এনসাক্লোপিডিয়া আমেরিকানার মতে, ‘সেক্যুলারিজম একটি নৈতিক অবস্থা যা কেবল প্রাকৃতিক নৈতিকতার মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং ওহির সূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম ও রহস্যবাদ মুক্ত।

’জ্যাকোব হোলিয়ক (Jacob Holyoake 1817-1906) এর মতে, সেক্যুলারিজম একটি কর্তব্য পালন পদ্ধতি— যা পার্থিব জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট, কেবল মানবীয় বিবেচনার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং যারা ধর্মতত্ত্বকে অনির্দিষ্ট, অবিশ্বাস্য বলে মনে করে তাদের জন্য প্রণীত।[২]

অক্সফোর্ড ডিকশিনারির মতে, ‘সেক্যুলারিজম হল এমন এক মতবাদ যা মনে করে— আল্লাহর বিশ্বাস ও পরকালের বিশ্বাস নির্ভর সমস্ত বিবেচনা থেকে মুক্ত থেকে মানবজাতির বর্তমান কল্যাণ চিন্তার উপর ভিত্তি করে নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে উঠবে।’বস্তুত, সেক্যুলারিজম হচ্ছে এমন এক বিশ্বাস যাতে ধর্ম কেবল ব্যক্তির নিকট থাকবে। কিন্তু ব্যক্তির ধর্ম পালন সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।

এর বিপরীত ঘটলেই উগ্রবাদী ধর্মান্ধ ট্যাগ দিয়ে গারদে পোড়া হবে। আদতে সেক্যুলারিজমই একটা বিশ্বাস (ধর্ম) যার বিরুদ্ধে কথা বলা মানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাওয়া।প্রকৃতপক্ষে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটা প্রাচীন মতবাদ। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে সফিস্টের মধ্যে এই ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়।

যা অলঙ্কৃত হয়ে বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিশাল স্থান দখল করে। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে ইহজাগতিকতাই দায়ী। তবে সেক্যুলারিজম মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে ইউরোপীয় পোপতন্ত্রের বিজ্ঞানীদের উপর অস্বাভাবিক নির্যাতন ভুলে গেলে চলবে না।

একটু একটু করে দানা বাঁধা ক্ষোভে আজকের এই দৈত্যের জন্ম।তবে আমাদের অতীতের ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে ও কুরআনের দুই-একটা আয়াত পুঁজি করে সেক্যুলারিজমের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে না জানার ভান করে বসে থাকার সুযোগ নেই৷

মানুষের সামনে এদেশের বুদ্ধিজীবীগণ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের উপর উদারতার পাতলা প্রলেপ দিয়ে সেক্যুলারিজম উপস্থাপন করছে। আর মানুষও সেটা দেদারসে গিলছে। পাঠক! মনে রাখতে হবে, স্থান ভেদে সেক্যুলারিজমের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড পরিবর্তন হয়ে যায়নি।

দীর্ঘদিন মনস্তাত্ত্বিক দাসত্বে থাকার দরুন আমাদের কাছে বিষয়টা স্পষ্ট নয়।গভীরভাবে খেয়াল করে দেখবেন, রাষ্ট্র পরিচালনা ও শিক্ষাব্যবস্থা উপরে উল্লেখিত সেক্যুলারিজমের সংজ্ঞা অনুসরণ করেই চলছে। সেক্যুলারিজমের নৈতিকতার মানদণ্ড হিসেবে আকলকে গ্রহণ করেছে।

এর মাধ্যমে সেক্যুলারগণ স্পষ্টরূপে বলতে চায়, ধর্ম (আল্লাহ) অপারগ হয়ে গেছে মানুষকে নৈতিকতা শেখাতে। তাই আমরাই আমাদের নৈতিকতা ঠিক করছি।তৎকালীন ইউরোপের প্রেক্ষাপটে সেক্যুলারিজম গ্রহণ যৌক্তিক ছিল বিধায় এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

বাতিল ধর্মের উপস্থাপনের দরুন তারা সমাজ থেকে ধর্ম ত্যাগ করে এসেছে। তাই হাল আমলে ইউরোপীয় রাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে পরিচালিত রাষ্ট্রে সেক্যুলারিজম বরাবরই ধর্মকে ত্যাগ করে চলছে, তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এখন কথা হল, মুসলিম বিশ্বে ইউরোপীয় মতবাদ গ্রহণ করার যৌক্তিক কতটুকু? আপনি যদি সংশয়বাদী হয়ে থাকেন তবে এখনই কেটে পড়ুন (এটা আপনার জন্য)।

মহান আল্লাহ নৈতিকতা মানদণ্ড হিসেবে ইসলাম নির্বাচিত করেছে। এটার উপর বিশ্বাসের কমতি ব্যক্তির মুসলমানিত্বের উপর প্রশ্ন তোলে। সুতরাং, ইসলাম ব্যতিরেকে অন্য কিছুকে নৈতিকতার মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করলে নৈতিকতার পুরো সংজ্ঞাটাই পরিবর্তন হয়ে যাবে।

পশ্চিমা দেশগুলোই এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। কথিত আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতায় সেক্যুলারিজমের ঝড় নৈতিকতা ধ্বংস করে ধর্মকেও জলাঞ্জলি দিয়েছে। এখন কথা হল মেঘ জমে থাকা মুসলিম বিশ্বকে নিয়ে। যারা উদারতার প্রলেপ সমেত সেক্যুলারিজম নিয়ে মাতামাতি করছে তাদের এখন চোখ কান খোলা উচিৎ।

সাথে সাথে মুসলিম চিন্তাবিদদের এই ভয়াবহতা উপলব্ধি করা উচিৎ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেক্যুলারিজমের ভয়াবহতা নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের ইতি টানছি। এদেশের মুখরোচক একটা স্লোগান হল, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। আদতে এই ধরনের বিশ্বাস লালন ধর্মীয় উৎসবের আধ্যাত্মিকতা ও আত্মিক পরিশুদ্ধতা বিনষ্ট করছে। আমরা যারা জাহিলিয়াত ঘোষণা করে ইসলাম গ্রহণ করেছি তারাই আবার জাহিলিয়াতের সাচ্ছন্দ্যে মিশে গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসাচ্ছি।

তাহলে আর ধর্মের যৌক্তিকতা কি রইল!পরিশেষে বলি, যেখানে এদেশে সেক্যুলারিজম দার্শনিক তাৎপর্য নিয়ে কাজ করছে; সেখানে আপনি আর আমি শাব্দিক অর্থ নিয়ে পড়ে আছি। সেক্যুলারিজমের কথিত বুদ্ধিজীবীদের লাগানো প্রলেপ খুলে দেখুন নিজের অজান্তে কত বড় দৈত্য পুষছেন! যার আগ্রাসনে ইউরোপ নৈতিকতায় মিসকিন হয়েছে এবং এর উত্তরসূরী হিসেবে এদেশও খুব একটা পিছিয়ে নেই।

তথ্যসূত্র:১. ৩০.১০.২০০৮ তারিখে বিআইসি কর্তৃক আয়োজিত ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ শীর্ষক সেমিনারে ড. মাহফুজ পারভেজ প্রদত্ত বক্তব্য। উদ্ধৃত সেমিনার স্মারক গ্রন্থ ২০০৮, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার নভেম্বর ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৮৯।২. জর্জ জ্যাকব হোলিয়ক, English Secularism: A Confession of Belief, শিকাগো, ১৮৯৬; উদ্ধৃত: সেমিনার স্মারক গ্রন্থ ২০০৮, বিআইসি, পৃ. ২১৯।Britannica, The Editors of Encyclopaedia. “Secularism”. Encyclopedia Britannica, 13 May. 2020, https://www.britannica.com/topic/secularism. Accessed 6 May 2021.

Leave a Comment