কারাগারের ঈদ – আবদুল্লাহ মায়মুন

বন্দিজীবনে আমার চারটি ঈদ অতিবাহিত হয়। এরমধ্যে গুম থাকাবস্থায় একটি, বাকী তিনটি কারাগারে। গুমের ঈদ অতি সাধারণভাবে অতিবাহিত হয়, দু’ বছর পূর্বে ২০১৯ সালের ঈদুল ফিতর গুম অবস্থায় অতিবাহিত করি। ঈদের রাত গুমকারীরা একটি পাঞ্জাবি দিয়ে বলে, ‘এটি ঈদ উপহার’। আর ঈদের দিন তারা যে খাবার খায় ওই স্পেশাল খাবারটিই দেয়। সকালে গরু গোস্তের খিচুড়ি, পায়েস এবং সেমাই। দুপুর ও রাতে মুরগির রোষ্ট, গরু ভূনা এবং মুগ ডাল। .এরপরের তিনো ঈদ কারাগারে কাটাই, কারাগারে আমি প্রথমে কুরবানির ঈদ পাই। আমরা থাকতাম সেলে, সেল থেকে বের হওয়ার অনুমতি নেই। কিন্তু ঈদের দিন আমাদেরকে পাহারা দিয়ে কারাগারের ভেতরের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ঈদের জামাত আদায় করার পর আবার আমাদেরকে সেলে দিয়ে দেওয়া হয়।

সেল থেকে বের হওয়াই আমাদের কাছে ঈদ। তাছাড়া দুনো ঈদ, ২৬মার্চ এবং ১৬ডিসেম্বর, বৎসরের এই চার দিন কারাগারের স্পেশাল খাবার দেওয়া হয়। উত্তরবঙ্গের ভাষায় বলে ‘বড় খাবার’! সকালে পায়েস ও মুড়ির নাস্তা, দুপুরে পোলাও দিয়ে ২৫০গ্রাম গরু বা খাসির ভূনা(যে যেটা পছন্দ করে), সাথে সালাদ, ড্রিঙ্ক, পান-সুপারি এবং রাতে সিদ্ধ ডিম ও আলুর দমের সাধারণ খাবার। তবে কারা-ক্যান্টিনে মিষ্টান্ন-পানীয়সহ রকমারি খাবার থাকে, চাইলে কেউ কিনে খেতে পারবে। স্বাবলম্বীরা ঈদে মিষ্টি-দই কিনে সবার মধ্যে ভাগ করে দেয়, আমরাও তাই করি এবং অর্ডার দিয়ে নুডলস, ভাজা মাছ ও সব্জির ব্যবস্থা করি। তাছাড়া ওইসব দিবসগুলোর পরের দিন বাড়ি থেকে খাবার ঢুকতে দেওয়া হয়। সেদিনও ভালো খাবার খাওয়া হয়। এদিনও থাকে ব্যস্ত মুখর।.গত ঈদুল ফিতরে ছিলো করোনার লক ডাউন, এজন্যে কারাগারে ঈদের জামাত হয় নি, আর আমাদেরও বের হওয়া হয় নি। দেখা-সাক্ষাত বন্ধ থাকায় বাড়ীর খাবার ঢুকতে দেওয়া হয় নি।

কিন্তু এরপরেও কুরবানির ঈদটা আমরা অনেকটা ব্যতিক্রমভাবে উদযাপন করি। বন্দি জীবনে এটিই ছিলো আমার স্পেশাল ঈদ।বক্ষমান লেখায় কুরবানির ঈদের উদযাপনটা বিস্তারিত উল্লেখ করবো ইনশাআল্লাহ। .২০২০সালের ৩ মার্চ, আমার আর আমার ড্রাইভার আব্দুর রহিমের জামিনের দু’টি কাগজ জেলে ঢুকে, মুক্তির পর আমদেরকে নিয়ে আসার জন্যে বড় ভাই মাওঃ আব্দুল্লাহ মুস্তাফীজ ও মামাত ভাই হাফিজ আদনান হাবীব জেলের বাহিরে অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু জঙ্গি অভিযোগে মামলা হওয়ার কারণে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারছেন না। তাই তাদের আগমনের সংবাদ আমি বিভিন্ন কারারক্ষীদের মাধ্যমে পাই। দুপুরে কাগজ ঢুকানো হয়, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত আসে, কিন্তু আমাদের বের হবার কোনো খবরই নেই, সেই দুপুর থেকেই আমরা প্রস্তুত হয়ে বসে আছি।

সন্ধ্যার সময় লক আপ করা হলো, তখন আমাদের টেনশন বাড়া শুরু হলো। ড্রাইভার আর আমি পাশাপাশি দু’টি পৃথক রূমে থাকতাম। মাগরিবের পর পরই রাতের খাবার খেয়ে নিলাম, আশা-টেনশন দুনোটা একই সাথে কাজ করতেছে, ইতিমধ্যে পাশের রূম থেকে শুনলাম, ড্রাইভার প্রচন্ড টেনশনে অসুস্থ হয়ে গেছে। হুঁশ চলে গেছে। এটি তার পুরাতন রোগ, টেনশনে তার এভাবে হয়। কিছুক্ষণ পর সুস্থ হলো। রাত ন’টায় ডেপুটি জেলার আসলো, আমাকে খুঁজে বলে, ‘অবস্থা ভালো নয়, জঙ্গি মামলায় আসামীদের বের করার সময় ডিবির ক্লিয়ারেন্স লাগে, আমাদের ক্লিয়ারেন্স আসে নি। নতুন মামলা দিতে পারে, তাই রাতে যেনো সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়ে দোয়া করি, আমার ভাইদের সাথে তার কথা হয়েছে, নিয়ম না থাকায় দেখা করাতে পারছে না।’যাক, পুরো রাত অঘুমে টেনশনে অতিবাহিত হয়।

এ রাত ছিলো আমার জীবনের লম্বা রাতগুলোর একটি।পরদিন দুপুরে শুনলাম, আমাদেরকে আরেকটা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। বড় ভাই আর আদনান আমাদের সাথে শত চেষ্টা করেও সাক্ষাৎ করতে পারেন নি। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসেন। কেননা আমাদের সাথে সাক্ষাতের নির্ধারিত তারিখ হচ্ছে পনের দিন পর পর মাসের ১ তারিখ আর ১৫ তারিখ। আর তারা এসেছেন ৩ তারিখে। তাই এ ব্যর্থ চেষ্টা আর এই অরণ্য রোদন।ঘটনার আকস্মিকতায় ড্রাইভার আব্দুর রহিম মানসিকভাবে ভীষণ আঘাত পায়। ফ্যাকাশে মুখ বানিয়ে আমাকে বলে, মুফতি ছাব, মনে চায় গলায় ফাঁস পরে আত্মহত্যা করে নেই!আমি হকচকিয়ে উঠি, তাকে বুঝাই, আল্লাহর ইচ্ছায় এক সময় সে স্বাভাবিক হয়।

.৮ তারিখ আমাদেরকে কোর্টে নিয়ে নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়, ১২ তারিখ শুধু আমাকে কোর্টে নিয়ে রিমান্ড আবেদন করা হয়। দু’দিন রিমান্ড মঞ্জুর হলো। ১৩ তারিখ রিমান্ডে নিয়ে গেলো। ১৫ তারিখ পর্যন্ত রিমান্ডে ছিলাম। পরিবারের লোক জানলো রিমান্ডে আছি, এজন্যে মাসের ১৫ তারিখও তারা সাক্ষাৎ করতে আসে নি, কেননা আসলেও পাবে না। এভাবে ১৫ তারিখও সাক্ষাৎ হলো না। এরপর শুরু হয় দেশব্যাপী লক ডাউন, গাড়ী-ঘোড়া বন্ধ, জেলে সাক্ষাৎ বন্ধ। করোনা চলাকালে আর কোনো সাক্ষাৎ চলবে না। পরিবারের সাথে সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয়েছিলো ১ডিসেম্বর ২০১৯সাল। এরপরে আর সাক্ষাৎ হয় নি। এরপর দীর্ঘ এক বছর পর ২০২০ সালের ৩ডিসেম্বর জেল থেকে মুক্তির মাধ্যমে সাক্ষাৎ হয়!!!এই লকডাউনের ভেতরেই কাটে আমাদের রমজান-ঈদ সবই। .লকডাউনে অফিস-আদালত বন্ধ এজন্যে জামিনের আশা নেই, যেহেতু দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ এজন্যে সাধারণ বন্দীদের জন্যে কারাগারে মোবাইলের ব্যবস্থা করা হয়, একজন বন্দি সপ্তাহে ১বার সর্বোচ্চ ৫ মিনিট করে পরিবারের লোকের সাথে কথা বলতে পারবে। যদিও ঘুষের মাধ্যমে অনেকে এর চেয়ে বেশি কথা বলে।

অনেকে জেল গেটে পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করে। কারণ মানি ইজ দ্য গ্রেট! এভাবে কারাগারের সব বন্দি সাজাপ্রাপ্ত আসামি, ফাঁসির আসামীও কথা বলতে পারে, একমাত্র জঙ্গি অভিযুক্ত মামলার বন্দি ছাড়া! এক্ষেত্রে জেলার-সুপার, মাসিক পরিদর্শনে আসা জজ-ডিসি এবং কারা ডি আইজির কাছে আবেদন করেও কোনো লাভই হয় নি। জঙ্গিরা মানুষ নয়, এরা আলেম হতে পারে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে, রাতে কিয়ামকারী আর দিনে সিয়াম পালনকারী হতে পারে তবুও এরা মানুষ নয়, এদের প্রতি আবার কীসের দয়া?বন্দী জীবন এমনিতেই কঠিন, এরমধ্যে যদি দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ থাকে, পিসিতে(পার্সোনাল ক্যাশে) যদি অঙ্ক না থাকে, তখন বন্দী জীবন আরো ভারী হয়ে যায়।

এদিকে তখন সেলে চলছিলো চরম কড়াকড়ি, একমাত্র কুরআন শরীফ ছাড়া পড়ার সব বই সিজ করা হয়, যুগান্তর পত্রিকা দেওয়া হত, তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়, (কিছু দিন পর অবশ্যই এগুলোর অনুমতি আবার দেওয়া হয়)! তাই দেশ-বিদেশের কোনো খবরই পাওয়া যেত না। আমার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য মা-বাবা, স্ত্রী ও ভাই-বোন থাকেন ব্রিটেন, কারারক্ষীদের মাধ্যমে শোনা গেলো ব্রিটেনে করোনা ভয়াবহ রূপে ছড়িয়ে পড়েছে, এতে আমার মধ্যে চরম অস্থিরতা বিরাজ করে। গুমের পর জেল খানায় ওই সময়টা ছিলো সবচেয়ে কষ্টের। জেলের ওই অবস্থায় তখন গুম আর জেলে তেমন পার্থক্য মনে হয় নি!!এভাবেই আমাদের রমজান আর ঈদুল ফিতর অতিবাহিত হয়। শোনা গেলো ভার্চুয়াল কোর্ট চালু হয়েছে, অনেকের দ্রুত জামিন হচ্ছে, কিন্তু জঙ্গি অভিযুক্তদের হচ্ছে না! পুরো সেল একটি হাহাকার পুরীতে পরিণত হয়।.এরপরে আমরা ভাবলাম সব সময় মনমরা হয়ে জীবন্ত লাশ হওয়ার কোনো অর্থ হয় না। এতে দেহ মন সব খারাপ হয়ে যাবে, লাভের লাভ কিছুই হবে না, মধ্যখানে খামাখা কষ্ট। এটা পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন, ইতিমধ্যে আমাদের কুরবানির ঈদ চলে আসলো।

আমরা ভাবলাম এ ঈদটা আমরা ব্যতিক্রমভাবে কাটাবো, তখন সেলে একজন ফাঁসির আসামিসহ মোট ছিলাম বাইশজন(সম্ভবত)। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, এবারের কুরবানীর ঈদে আমরা সেলে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবো, অনুষ্ঠানকে সফলভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়।অনুষ্ঠানকে বোঝার জন্যে সেল সম্পর্কে একটু ধারণা দেই।.বগুড়া জেলা কারাগারে ঢুকেই উত্তর দিক হাতের ডানদিকে ২৫-৩০গজ হাটার পর চতুর্দিকে দেয়ালবেষ্টিত এক তলাবিশিষ্ট একটি ভবন পাবেন। দেয়ালটির জেলের ভেতরের দুই অংশ ৬ফুট উঁচু আর বাহিরের দুই অংশ হচ্ছে জেলখানারই দেয়ালই। তো নরমাল দরোজা দিয়ে সেলে ঢুকেই দেখবেন ডানদিকে তিন হাত×পাঁচ হাতের ছোট্ট বাগান, যেখানে ওষুধি গাছ, ধনিয়া-পেয়াজ-রসুনসহ বিভিন্ন ফুলগাছের সমাহার। বাগানের একটু সামনেই আড়াই হাত×পাঁচ হাতের ছোট পানির হাউজ, পানির ট্যাপ আছে দু’টি। এখানে অজু-গোসল করা হয়। আর হাতের বামদিকে সাড়ে তিন হাত×পাঁচ হাত করে ভেতরে এটাচড বাথরুমসহ সারিবদ্ধ পাঁচটি রূম।

বাগান আর রূমের মধ্যখানে সাত হাত প্রস্থ এবং পঁচিশ হাত দৈর্ঘের খোলা প্রাঙ্গণ। বাগানের ওই অংশ মাটির, এ ছাড়া সেলের নিচের পুরো দিক পাকা। পাঁচ রূম, বাগান, হাউজ এবং মধ্যখানের প্রাঙ্গণের দেয়ালবিশিষ্ট এলাকার নামই জাফলং সেল। এটিই আমাদের তখনকার ঘর, বাড়ী, গ্রাম-দেশ এককথায় পুরো দুনিয়া। বগুড়া কারাগারে দু’টি সেল আছে, একটি জাফলং সেল আরেকটি আত্রাই সেল।এখানের বন্দিরা বাহিরে যেতে পারবে না, আর বাহিরের বন্দিরা এখানে আসতে পারবে না। একমাত্র কারা-কর্তৃপক্ষ ও সাজাপ্রাপ্ত সেবক আসামি ছাড়া।এই জাফলং সেলে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২০২০সালের অগাষ্ট মাসের ঈদুল আজহার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান!.আয়োজক কমিটি সিদ্ধান্ত নিলো, প্রতিযোগিতা হবে সংস্কৃতি, শিক্ষা ও বিনোদন বিষয়ে। কিছু থাকবে ঐচ্ছিক এবং কিছু থাকবে বাধ্যতামূলক। যেহেতু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লক খোলা থাকে তাই এ সময়েই প্রতিযোগিতা হবে।

একজন বয়স্ক অসুস্থ ভাই ছাড়া বাকী ২১ জনই এতে অংশগ্রহণ করবে। ওই ভাই থাকবেন বিচারকের ভূমিকায়।প্রতিযোগিতার বিষয়ঃ১- সুরা হুজুরাতের তাফসীর ২- আযান৩- ইসলামি সংগীত৪- তেলাওয়াত ৫- কবিতা আবৃত্তি (স্বরচিত হলে বেশি নম্বর পাবে)৬- হাউজের পানিতে ডুব দিয়ে থাকা৭- পাঞ্জা৮- বল ছুড়ে বোতল টার্গেট বানানো৯- পুশ আপ১০- উপস্থিত জ্ঞান১১- কৌতুক-গল্পের মাধ্যমে প্রত্যেকের আঞ্চলিক ভাষা প্রদর্শন। .অধিকাংশ প্রতিযোগিতায় ১ম তিনজন বিজয়ীদের মধ্যে পুরষ্কারের ব্যবস্থা করা হয়। কারাগারের নগদ টাকা চলে না এছাড়া আছে অনেক বিধি নিষেধ, এজন্যে কারানিয়মের ভেতরে থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহারিক দ্রব্য এবং খাবারের মাধ্যমে পুরষ্কার ঠিক করা হয়। প্রতিযোগীদের মধ্যে ছিলেন হাফিয, আলেম, মুফতি, ইঞ্জিনিয়ার, দিন মজুর, ড্রাইভার-মিস্ত্রি এবং ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার লোক।আলেমরা দীনি বিষয়ে পরীক্ষক হন, বাকীরা যোগ্যতা অনুযায়ী অন্যান্য বিষয়ে পরীক্ষক হন। এভাবেই বিচারক ঠিক করা হয়। সেই সুবাদে আমি সুরা হুজুরাতের তাফসীর, আযান, উপস্থিত জ্ঞান ও সঙ্গীতের বিচারক নির্ধারিত হই। প্রতিযোগিতার ঘোষণা হতেই সবার মধ্যে একধরনের আমেজ চলে আসে, দীর্ঘদিনের মনমরা ভাব চলে গিয়ে একটি আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়, পাঁচ রূমের প্রতিটি রূমেই প্রতিযোগিতার ভাব চলে আসে, কীভাবে বেশি পুরষ্কার পাওয়া যায় এজন্যে শুরু হয় রূম ভিত্তিক ছলা-পরামর্শ।

চঞ্চল পরিবেশে অংশগ্রহণের প্রস্তুতির কারণে আমরা ভূলেই যাই যে, আমরা কারাগারে আছি।কুরবানির ঈদের তিন-চার দিন পুর্ব থেকে পাঞ্জার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শুরু হয় অনুষ্ঠান। যেহেতু এটা শক্তির ব্যাপার-স্যাপার, এক দিনেই পুরোটা শেষ করা শক্ত, এ জন্য প্রথম রাউন্ড – দ্বিতীয় রাউন্ড, সেমি ফাইনাল-ফাইনালের মাধ্যমে শেষ হবে। প্রতিযোগিতার প্রথম কয়েক ধাপ বিভিন্নরূমে হবে আর ফাইনাল সেমি-ফাইনাল ঈদের আগের দিন এবং ঈদের দিন মাঠে হবে। আমি টেনে টুনে সেমি ফাইনালে যাই, পরে ২৭মিনিট লড়াই করে হেরে যাই। বিজয়ী প্রথম তিনজন পুরষ্কার পাবে বিধায় আমি বঞ্চিত হই। তবে আমার ড্রাইভার পাঞ্জায় প্রথম পুরষ্কার পায়। এভাবে শুরু হয় অন্যান্য প্রতিযোগিতা, কোনোটায় আমি বিচারক আবার কোনোটায় প্রতিযোগী! পুশ আপ, পানিতে ঢুব দেওয়া, ঢিল ছোড়া, কবিতা, তেলাওয়াত, আযান ইত্যাদিতে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়।এভাবে আমাদের সব প্রতিযোগিতা খোলা আকাশের নিচে সেলের প্রাঙ্গণে কম্বল আর বিছানার চাদর বিছিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সেলের দক্ষিণ পাশে বায়বীয় মঞ্চ স্থাপন করা হয়।ঈদের দিন সকালে হয় সংগীত প্রতিযোগিতা, অংশগ্রহণকারীরা একে গান পরিবেশন করতে থাকে, একজন স্বরচিত একটি গান গায়, গানের মধ্যে ঈদে বন্দিদের পরিবারের করুণ দৃশ্য তুলে ধরে, আসে বাচ্চাদের প্রসঙ্গ।

বন্দিদের বাচ্চারা অন্য প্রতিবেশিদের বাচ্চাদের নতুন জামা-কাপড় দেখবে, চকলেট-মজার খাবার দেখবে, কিন্তু খেতে পারবে না, কিনতে পারবে না। কারণ বাবা জেলে, কে দিবে তাকে এসব জামা-কাপড়, চকলেট-বিস্কুট! আহ! কী নির্মম করুণ দৃশ্য!! তখন উপস্থিত অনেকের যাদের বাচ্চা আছে তাদের বাচ্চাদের কথা স্মরণ হয়, আর তাদের চোখে পানি চলে আসে। কয়েকদিনের বর্ণিল আনন্দ যেনো চোখের জলে ভাসতে শুরু করছে।কিছুক্ষণ পর আসেন আরেক প্রতিযোগী, মাথায় সুতার সাদা টুপি, পরনে পাঞ্জাবি-পাজামা আর থুতনিতে এক বিঘত লম্বা দাড়ি। মঞ্চের দেয়ালে অনেকটা টেস লাগিয়ে দাঁড়ান। বিয়ের প্রায় দু মাস পর ধরা খান, কারাগারে আসার পর মেয়ের জন্ম হয়। প্রায় পাঁচ বছর ধরে জেলে আছেন। বাবা নেই, আছে দুঃখিনী মা। স্ত্রী মেয়ে থাকে শ্বশুর বাড়ী। বাড়ীতে একাই দুঃখিনী মা থাকেন। খুব কষ্টে তার এবং পরিবারের দিন যাচ্ছে।

তো তিনি এসে গাওয়া শুরু করেন কারাগারের জনপ্রিয় গান-‘আমি কুরআনের কর্মি আছি বগুড়া জেলা কারাগারে!আমি কারাগার থেকে গানে গানে বলছি কথা তোমরা সবার তরে!আমি ভালো আছি বেশ ভালো আছি, নেই দুঃখ-বেদনা কোনো!শুধু দোয়া চাই সবে দোয়া করো তোমরা যারাই আমাকে চেনো।আমি সত্য পথের পথিক বন্ধু, শুধু এই দোষ বলে,আজ বহু দিন-মাস কারাগারে পড়ে আছি বাতিলের রোষানলে!তবু দুঃখ করি না আল্লাহ সহায় নেই নেই কোনো ভয়!আমি বিশ্বাস করি মিথ্যাচারের হবে হবে পরাজয়!…এতটুকু বলতেই শুরু হয় সবার মধ্যে কান্না। এমন কেউ নেই যে চোখের পানি ফেলে নি। এমন কি জেলের কারারক্ষী পর্যন্ত কান্না শুরু করে। গানের মধ্য যখন তিনি ‘আ- আ- ও হো হো’ বলে টান দেন তখন মনে হয় তার আর্তনাদ শুনে জান বের হয়ে যাচ্ছে।..তিনি সাথীদের কথা, নিজেদের কষ্টের কথা গানে গানে তুলে ধরেন। মায়ের কথা এভাবে তুলে ধরেন,.. ‘বুঝি বহুদিন ধরে দেখে নি দু’চোখ দুঃখিনী মায়ের মুখ,বাবার স্নেহের কথা মনে পড়ে কেঁদে কেঁদে উঠে বুক! আমি মাঝে মাঝে দেখি গ্রীলের ওপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে মা,তার কাঁদা কাঁদা মুখ দেখে যাই কিছু বলতে যে পারি না!আমি পরক্ষণে নিজেকে চিনিয়া ভুলে যাই সব কথা,আর মাকে বলি, ‘মা’ ভালো থেকো এই বলে শেষ করি কথা!!……..এভাবে তিনি গানের একেক লাইন বলেন, আর আমরা একেকটি স্মৃতিময় করুণ দৃশ্যে হারিয়ে যাই, অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী করুণসুরে বলে যান। সবাই কাঁদতে থাকে কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না, কে দেখবে কার কান্না। সবারই যে একই অবস্থা, কে কাকে থামাবে।

সবাই যে নিজে ভুক্তভোগী। মনে হচ্ছে শুধু আমরা নয়, বরং সেলের আকাশ-বাতাস, ইট-পাথর বালু সবাই কান্না করছে। এর আগে এ গান অনেকবার শোনা হলেও কোনোবারই এভাবে প্রতিক্রিয়া হয় নি, এবার মনে হলো এই গান প্রথম শুনতেছি। আজ এতদিন পর যখন স্মৃতিগুলো লিখতেছি তখনো দৃশ্যগুলো ভেসে উঠতেছে। আর হাত দিয়ে চোখের পানি সংবরণ করতেছি। পুরো গানটি শুনতে চাইলে গানের প্রথম লাইন লিখে ইউটিউবে সার্চ দেন।.একপর্যায়ে তার গান শেষ হয়। গানের কথা, সুর, কন্ঠ এবং পরিবেশের কথা বিবেচনা করে বিচারকরা তাকে সর্বোচ্চ মার্ক দেন।

তিনি হন সংগীতে বিজয়ীদের প্রথম। আরো অনেকে পৃথকভাবে তাকে পুরষ্কার দেন। এরপর আমরা নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষা প্রদর্শন করি, সিলেট-নোয়াখালী, চিটাগাং-বগুড়া, চাপাইনবাবগঞ্জ বিভিন্ন জেলার ভাষায় কৌতুক-গল্পে নিজেদের ভাষা প্রদর্শন করা হয়।ঈদের দিন বেলা এগারটা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলে। এরপরে দুপুরের খাবার ও বিরতি। বাদ আছর পুরষ্কার বিতরণের ঘোষণা করা হয়।প্রাঙ্গণে জামাতের সাথে আছরের নামায হয়। এরপর আমার সঞ্চলনায় প্রথমে বিভিন্ন জনের অনুভূতি শোনা হয়, এরপর পুরষ্কার বিতরণী।প্রথম পুরষ্কার একটি খাবারের প্লাস্টিকের মগ, দ্বিতীয় পুরষ্কার মি.টুইস্ট চিপস, তৃতীয় পুরষ্কার বোম্বে পটেটো। আর সাধারণ পুরষ্কার ইলুবিলু ওয়েফার। এছাড়া স্বতন্ত্রভাবে বিভিন্ন জন বিভিন্ন জনকে টিস্যু-সাবান দ্বারা পুরষ্কৃত করে। আমি দুটি মগ পুরষ্কার স্বরূপ পাই। একটি একজনকে জেলের ভেতরেই হাদিয়া দেই। অন্যটি স্মৃতি স্বরূপ নিয়ে আসি। ছবির এ মগ হচ্ছে আমার অর্জিত পুরষ্কার।

Leave a Comment