সত্য নবী সিরিজ – লেখক আসিফ মাহমুদ

কেউ কেউ এও বলে থাকেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) সমাজ-সংস্কারের উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলেছিলেন। আরবের লোকেরা তখন পাপাচারে নিমজ্জিত ছিলো। তাই তাদেরকে পাপাচার থেকে দূরে সরিয়ে আলোকিত সমাজ, সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মুহাম্মাদ (ﷺ) নবী হওয়ার নাটক করছিলেন। ভালো যুক্তি। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁকে আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করার কী প্রয়োজন ছিলো? তাঁর নবুয়তী জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে পাঠক দেখবেন, মাক্কী জীবনের প্রায় পুরো সময়টাই তিনি তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ (রব হওয়ার ক্ষেত্রে, ইবাদাতের ক্ষেত্রে এবং গুণের ক্ষেত্রে) প্রতিষ্ঠার দাওয়াত দিয়েছেন।

সমাজ-সংস্কারের জন্য তো আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার বাদ দিয়ে অন্য ভালো কাজগুলোর দাওয়াত দিতে পারতেন আর কাফিররা সেটা অনায়াসে মেনেও নিতো। এইযে সূরা কাফিরুন নাযিলের প্রেক্ষাপটটাই দেখুন। আসওয়াদ বিন মুত্তালিব, ওয়ালীদ বিন মুগীরা, উমাইয়া বিন খালাফ এবং আস বিন ওয়ায়িল সাহমী মুহাম্মাদের (ﷺ) নিকট এসে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছিলো। এর মধ্যে একটি হলো—তারা মুহাম্মাদের (ﷺ) রবের ইবাদাত করবে, বিনিময়ে মুহাম্মাদকেও (ﷺ) তাদের রবের ইবাদাত করতে হবে। এর প্রেক্ষিতে সূরা কাফিরুনের আয়াত নাযিল হয়। “বল, হে কাফিররা! তোমরা যার ইবাদাত করো, আমি তার ইবাদাত করি না” আবার তারা দ্বিতীয় আরেকটি প্রস্তাব করে—যদি মুহাম্মাদ (ﷺ) একবছর তাদের রবের ইবাদাত করেন, তাহলে তারা আল্লাহর ইবাদাত করবে।

তৃতীয়ত, তারা কুরআনের কিছু অংশ পরিবর্তন করার প্রস্তাবও দিয়েছিলো। খেয়াল করুন, কেবলই সমাজ-সংস্কার যদি উদ্দেশ্য হতো, তবে তো কাফিরদের এই প্রস্তাব মেনে নেয়ায় মুহাম্মাদের (ﷺ) কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা নয়। কিন্তু না, তিনি তা মেনে নেন নি। তিনি তাঁর দাওয়াতে অটল ছিলেন। ‘আল্লাহ ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য কোনো ইলাহ নেই’ এই একটি কথাকে সমাজে প্রতিষ্ঠত করার জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন—যা সমাজ-সংস্কার কিংবা শান্তি প্রতিষ্ঠার সাথে মোটেই সম্পর্কিত না।

এছাড়া সমাজ-সংস্কারই যদি উদ্দেশ্য হতো, তবে তিনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর জন্য রক্ত ঝরালেন কেন? একটা উদাহরণ দিয়ে আলাপ শেষ করি। ধরুন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে। জাতীয়তাবাদের আবেগে কাঁপছে দু’দেশ। ভারতের দিল্লীতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হাজার মানুষের মিছিল হচ্ছে। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্ভুদ্ধ একদল লোক গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দিচ্ছে। এমন অবস্থায় যদি ভারতে বসবাসরত কোনো পাকিস্তানি সেই মিছিলের মাঝখানে পাকিস্তানের পতাকা উঁচিয়ে ধরে, তার কী অবস্থা হবে? অথচ, নিজ দেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরা দোষের কিছু নয়।

কিন্তু তারপরও কোনো সুস্থ মানুষ এমন কাজ করবে না। যদি এই কাজ করার জন্য তাকে অনেক অর্থসম্পদের লোভও দেখানো হয়, তারপরও করবে না। আর যদি এমন হয় যে—এর বদলে সে অর্থসম্পদ পেতেও পারে, নাও পেতে পারে সেক্ষেত্রে তো কেউ এমন কাজ করার কথা মনেও আনবে না। ধরুন, ভারত অন্যায় করছে। তাই ভারতের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ করার জন্য তাকে পতাকা উচিয়ে ধরতে হবে। করবে কেউ? পাগল ছাড়া কেউ বোধহয় করবে না। তাহলে ভাবুন, মূর্তিপূজার আস্তানা তৎকালীন আরবে মুহাম্মাদ (ﷺ) সরাসরি মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া উদাহরণে বলা ঘটনাটির মতই আত্মঘাতি না? অর্থসম্পদের জন্যও কি তিনি এই কাজ করতে পারেন? এক্ষেত্রে তো অর্থসম্পদ বা দুনিয়াবি অর্জন তিনি আদৌ পাবেন কী-না তার কোনো নিশ্চয়তাও ছিলো না। অনিশ্চিত অর্জনকে সামনে রেখে তিনি জীবন বিপন্ন করবেন? কিংবা কেবল সমাজ-সংস্কারের জন্য? আপনার যুক্তি কী বলে পাঠক?

তারপর মুহাম্মাদের (ﷺ) জীবনের বাকি ঘটনাগুলো স্মরণ করুন। মক্কায় একাধিকবার তাঁকে হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে। কখনো শ্বাসরোধ করে। কখনো বড় পাথর মেরে। তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে তিন বছরের জন্য বয়কট করে ক্ষুধা-তৃষ্ণার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। তায়েফে দাওয়াত দিতে গেলে তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছে। হিজরতের দিন ১১ জন মিলে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে হত্যার পূর্ণ ছক সাজানো হয়েছে।হিজরতের দিন তাঁকে জীবিত কিংবা মৃত ধরে আনার জন্য একশো উট পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে।

উহুদের দিন তাঁর দাঁত ভেঙে দেয়া হয়েছে, চোখে লোহার শলা ঢুকে গিয়েছিলো। এই এতকিছু, মিথ্যার জন্য? দুনিয়াবি অর্জন তো তাঁর ছিলোই না কিছু। তাহলে অকারণ তিনি মিথ্যা বলে গেছেন? মিথ্যা বলে এত যন্ত্রণা সহ্য করেছেন? মৃত্যুভয় নিয়ে প্রতিমূহুর্ত বেঁচেছিলেন, কীসের প্রয়োজনে? পাঠক, নির্মোহ হয়ে চিন্তা করুন। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখুন। আপনার কী মনে হয় এই মানুষটি মিথ্যা বলেছিলেন? তিনি মিথ্যা বলেননি, এটা মেনে নিলেই তাঁর নবুয়ত সত্য হবে বিষয়টি এমন না। কিন্তু তাঁর জীবনকে নির্মোহভাবে দেখলে, গবেষণা করলে, কোনো সচেতন মানুষেরই এটা বিশ্বাস হবে না যে, তিনি মিথ্যাবাদী ছিলেন। #সত্য_নবী_সিরিজ-আসিফ মাহমুদ

Leave a Comment