ঢাকার কোন এক ব্যাস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি।ওপাশ থেকে হাতে মোবাইল নিয়ে এক ভদ্রলোক রাস্তা ক্রস করছেন। পাশেই ফুটওভার ব্রীজ ছিলো। তিনি সেটাতে না গিয়ে মাঝ রাস্তা বরাবর হেঁটে আসছেন।
তাড়া বেশি না সচেতনতা নেই বুঝলাম না।প্রচন্ড গতিতে একটা বাস ধেয়ে আসছে তার দিকে।হর্ণ দেয়া হচ্ছে, ভদ্রলোকের ভ্রুক্ষেপ নেই। তার মনোযোগ মোবাইলে। একমুহূর্তের জন্যও মোবাইল থেকে চোখ সরছে না।
বাসটা ভদ্রলোককে চাপা দিয়ে চলে যাবে। এপাশে আমরা যারা দাঁড়িয়ে ছিলাম ভদ্রলোককে চিৎকার করে সতর্ক করার চেষ্টা করছি। তিনি মোবাইল থেকে মুখ তুলছেন না। ধীর পায়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। রাস্তার এপাশে লোকজন যেন দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে দেখছে।বাসটা গতি কমায়নি।
একদম যখন চাপা দিয়েই দিবে, ঠিক তখন একটা ছেলে ভদ্রলোকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে সরিয়ে দিলো।বাসটা চলে গেলো যেখানে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলো সেখান দিয়ে। আর ছেলেটা লোকটাকে নিয়ে পড়লো রাস্তায়। নিশ্চিতভাবে জানে বেঁচে গেলেন ভদ্রলোক।আমরা এপাশে যারা অবাক হয়ে দেখছিলাম, চিৎকার করে সতর্ক করতে চেষ্টা করছিলাম, আমরা হাঁপ ছাড়লাম।
ছেলেটা বসে ছিলো রাস্তার মধ্যে আইল্যান্ডে।রাস্তায় এমন কিছু ছেলেদের দেখা যায় যারা আইল্যান্ডে গোল হয়ে বসে থাকে। সবার হাতে থাকে পলিথিন টাইপের কিছু, আর পিঠে থাকে সাধারণত কাগজ কুড়ানোর জন্য বস্তা। সভ্য সমাজে তারা টোকাই নামে পরিচিত।
একদম শেষ মূহুর্তে ছেলেটা আইল্যান্ড থেকে এসে ভদ্রলোককে না সরালে আজকে ঘটনা ঘটে যেত নিশ্চিত।ভদ্রলোক উঠেই ছেলেটাকে চড় বসিয়ে দিলেন।”হতভাগা তুই আমাকে ধাক্কা দিলি কেন?”একথা বলে হয়তো আরো মারতেন। তার আচরণে তেমনই মনে হচ্ছিলো।
রাস্তার এপাশের প্রায় সবাই তেড়ে গেলো তার দিকে।”এই ছেলেটা ধাক্কা দিয়ে আপনার জীবন বাঁচিয়েছে।না হলে বাস আপনাকে চাপা দিয়ে চলে যেতো।আপনি ওকে মারলেন কেন?”সবাই লোকটাকে ঘিরে একথা বলছে, তার আচরণে ক্ষোভ দেখাচ্ছে। তার আচরণ আসলেই মানবিক ছিলো না।
ভদ্রলোকের মোবাইল, পিঠের ব্যাগ পড়ে গিয়েছিলো রাস্তায়। আমি সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে তার হাতে দিলাম।এদিকে ভদ্রলোক এতো লোকের কথা শুনে হয়তো পুরো ঘটনাটা বুঝতে পেরেছেন। তিনি মানিব্যাগ বের করে সেখান থেকে একশ টাকা নিয়ে ছেলেটাকে দিলেন।আমি তাকিয়ে আছি ছেলেটার দিকে।
খালি গা, খালি পা, একটা প্যান্ট পড়া। গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে কিন্তু প্রশ্ন বা রাগ নেই। তার চোখের দৃষ্টি শূন্য। সম্ভবত এমন অমানবিক আচরণ তার কাছে নতুন নয়।ছেলেটা টাকাটা নিলো। হাতে গুঁজে চলে যাচ্ছিলো।ঘিরে থাকা জনতায় এক মুরুব্বি ছিলেন। অনেক বয়স হবে, চুল দাঁড়ি সাদা।
তিনি ছেলেটাকে ডাক দিলেন। ডাক দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে আদর করে দিলেন।আমার কাছে খুব ভালো লাগলো দৃশ্যটা। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।মুরুব্বি আমাকে প্রশ্ন করলেন, “ওনার মোবাইলটার দাম কতো”?আমি অবাক হয়ে গেলাম তার কথা শুনে। তার মানে তিনি আমাকে দেখেছেন লোকটার মোবাইল তুলে দিতে। আমি এতটা খেয়াল করিনি। স্যামসাং সেট ছিলো মনে হয়। আমি বললাম, ” দামী সেট।
হয়তো পঁচিশ হাজার বা তার চেয়েও বেশি হবে।”রাস্তার পাশে গিয়েছে ততক্ষণে লোকটা। পাশে তখনও লোকজন ভিড় করে আছে। এখন পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। ছেলেটার কথা ভুলে গেছে সবাই।সবাই তিনি কোথাও ব্যাথা পেয়েছে কিনা সেটা জানতে চাচ্ছে। ভদ্রলোক হাসি মুখে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। হাতে মোবাইল।
মুরুব্বি লোকটার সামনে গিয়ে তার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিলেন। নিয়ে সর্ব শক্তিতে ছুঁড়ে ফেললেন মোবাইল রাস্তায়। মোবাইলটা একটু দূরে গিয়ে পড়ে ভেঙে গেলো। ব্যাস্ত রাস্তায় গাড়ি চলে গেলো সেই ভাঙা মোবাইলের উপর দিয়ে।লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রাস্তার লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
আমিও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।মুরুব্বি তার বুকপকেট থেকে কাগজের ভাঁজে রাখা টাকা থেকে একহাজার টাকার একটা নোট বের করে লোকটার হাতে দিলেন।লোকটা হয়তো মুরুব্বিকেও কিছু বলতো। কি মনে করে চুপ হয়ে গেলো, আর কিছু বললো না।মুরুব্বি বললেন,” জীবন বাঁচাতে ছেলেটাকে একশত টাকা দিয়েছিলেন।
কালকে মোবাইলটার জন্য আবার আপনি যদি মরে যান, তাই আমি মোবাইল ভেঙে দিলাম। দশ গুণ টাকা বেশি দিলাম, আমাকে মাফ করে দিবেন।”মুরুব্বি চলে যাচ্ছেন। লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ভাঙা মোবাইল আর নিতে যাচ্ছে না। তাকে ঘিরে থাকা লোকজন ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে।
শুধু সেই টোকাই ছেলেটা নিজের মনেই হাসছে। আবার সে ফিরে গিয়েছে রাস্তার মাঝের আইল্যান্ডে।তার হাসি বড় অদ্ভুত ছিলো। সেই হাসিতে কোথাও না কোথাও জীবনের অর্থ লুকানো ছিলো।আমরা যা বুঝি সবসময়, কিন্তু এড়িয়ে যাই প্রত্যেকবার।
-টোকাই-পিয়াস মাহবুব খান