ফিলিস্তিনের মানুষের ওপর জুলুম দেখে আমাদের ঈমান যেন দুর্বল না হয়ে যায়, বরং আরো উজ্জীবিত হয়…গত কয়েকদিন ফিলিস্তিনে যা হচ্ছে, আমরা যা দেখছি তা দেখে আধ্যাত্মিক কিছু বিষয় বিশেষ করে ধর্মতাত্বিক ও আকিদাগত কিছু বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
কারণ মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো, যখন আমরা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ি, চারিপাশে কোনো কূল কিনারা না দেখি, তখন আমাদের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়। ফিলিস্তিনের কথাই ভাবুন, আমরা যারা জীবিত আছি, গোটা জীবন জুড়েই আমরা কমবেশি ফিলিস্তিনের হাহাকার আর জুলুমটাই দেখে গেলাম।
আশার কোনো লক্ষন দেখা গেলো না। উল্টো পরিস্থিতি যেন খারাপ থেকে আরো বেশি খারাপের দিকেই যাচ্ছে। আল আকসায় আগুন জ্বলছে। মসজিদের ভেতর ইহুদী সেনারা প্রবেশ করে গুলি করছে, মানুষ হত্যা করছে।এরকম পরিস্থিতি দেখলে অনেকেরই মনে প্রশ্ন ও সংশয় জাগতে পারে।
আমরা যেহেতু নিজেদেরকে সত্যনিষ্ঠ দ্বীনের অনুসারী মনে করি, তাই ইসলামের বিপর্যয় বা মুসলিমদের নিপীড়নের দৃশ্য আমরা মেনে নিতে পারি না। এটা স্বাভাবিক। হুদাইবিয়া সন্ধির সময় যখন রাসুল সা. কুরাইশদের একের পর এক শর্ত মেনে নিচ্ছিলেন, এমনকী আপাতদৃষ্টিতে মুসলিমদের পরাজয় ঘটছে বলেও যখন মনে হচ্ছিলো,
তখন উমর বিন খাত্তাবের রা. মত সাহাবিও প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘হে রাসুল সা.। আমরা কি হক্বের ওপর নেই? তাহলে কেন আমরা অপদস্থ হবো? কেন আমরা ওদেরকে বেশি সুবিধা দেবো?’ তখনও হযরত আবুবকরের রা. মতো সাহাবি ছিলেন, যিনি উমরকে রা. শান্ত করেছিলেন। তাকে বুঝিয়েছিলেন।
হযরত উমরের রা. এ আবেগও অস্বাভাবিক ছিল না। ইসলামের আওতায় থেকে একজন মুসলিম নিজেদের জন্য মর্যাদা ও প্রশান্তি আশা করতেই পারে। এক্ষেত্রে প্রথম যা মনে রাখতে হবে তা অনেকেরই মানতে বেশ কষ্ট হয়। তাহলো, রাজনৈতিক বিজয় কোনোভাবেই আল্লাহর সন্তুষ্টির নিদর্শন নয়।
প্রকারান্তরে রাজনৈতিক পরাজয়ও আল্লাহর অসন্তোষের কোনো লক্ষণ নয়। এ দুনিয়ায় ইজ্জত আর আল্লাহর চোখে ইজ্জত এক হবে না। আল্লাহর কাছে অতি সম্মানিত ব্যক্তিও দুনিয়ার মানুষের কাছে লাঞ্ছিত হতে পারেন। কিন্তু সেই অপমান ও অবমাননার জন্য তার ইজ্জত কমে যাবে না।
মুসলিমদের জন্য এ দুনিয়া কখনোই চুড়ান্ত লক্ষ্য নয়, হতে পারে না। কারণ দুনিয়ার যা নেয়ামত আল্লাহ পাক তা বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সকলের জন্যই বরাদ্দ রেখেছেন।আল্লাহ পাক বলেন, “যে কেউ ইহকাল কামনা করে, আমি সেসব লোককে যা ইচ্ছা সত্ত্বর দিয়ে দেই। অতঃপর তাদের জন্যে জাহান্নাম নির্ধারণ করি।
ওরা তাতে নিন্দিত-বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে।” (সুরা বনী ইসরাইল: আয়াত ১৮)আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন, “এদেরকে এবং ওদেরকে প্রত্যেককে আমি আপনার পালনকর্তার নেয়ামত পৌঁছে দেই এবং আপনার পালকর্তার দান সবার জন্যেই উম্মুক্ত।” (সুরা বনী ইসরাইল: আয়াত ২০)
মক্কী জীবনে হযরত ইয়াসির রা. ও হযরত সুমাইয়া রা. শাহাদাত বরণ করেছিলেন। আরো অনেকেই জীবন দিয়েছিলেন। অথচ তাদের কেউই মদিনার জীবন, যুদ্ধের বিজয় বা মক্কা বিজয় কিছুই দেখতে পারেননি। মক্কী যুগের প্রথম দিকের এ শাহাদাতের পর আরো প্রায় এক যুগ পর্যন্ত রাসুল সা. সাহাবিদের নিয়ে মক্কায় ছিলেন।
তারা অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করেছিলেন। তাদের সামনেও সুদিনের ন্যুনতম কোনো ইংগিত ছিলো না। তারপরও তারা ঈমানের পূর্ণমানে নিজেদেরকে অটল রাখতে পেরেছিলেন। দুনিয়ার ক্ষমতাকে যারা বড়ো কিছু মনে করেন, আল্লাহ সময়মতো তাদেরকে এমনিতেই নি:শেষ করে দিতে পারেন।
আল্লাহ বলেন, “তারা পৃথিবীতে অযথা অহংকার করল এবং বলল, আমাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিধর কে? তারা কি লক্ষ্য করেনি যে, যে আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিধর ? বস্তুতঃ তারা আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করত। অতঃপর আমি তাদেরকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনার আযাব আস্বাদন করানোর জন্যে তাদের উপর প্রেরণ করলাম ঝঞ্ঝাবায়ু বেশ কতিপয় অশুভ দিনে। আর পরকালের আযাব তো আরও লাঞ্ছনাকর এমতাবস্থায় যে, তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না।” (সুরা হামিম আস সাজদাহ: আয়াত ১৫-১৬)
অপরদিকে, রাসুল সা. বলেছেন, আল্লাহ যাকে বেশি ভালোবাসেন, তাকে অধিক পরীক্ষায় ফেলেন। তাই বিপদাপদকে শুধু বিপর্যয় হিসেবেই নয়, বরং আল্লাহর কাছে মর্যাদা বৃদ্ধির একটি সোপান হিসেবেও বিবেচনা করা উচিত। আর আমরা যদি সত্যিকারার্থে ঈমানদার হই, তাহলে আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, এখন যা নেতিবাচক হচ্ছে তার চেয়ে ইতিবাচক কিছু আল্লাহ আমাদের জন্য নির্ধারন করে রেখেছেন।
হয়তো নেতিবাচক বিষয়গুলো অনেক বেশি হৃদয় বিদারক হবে, কষ্টকর হবে। কিন্তু এই মর্মান্তিক নেতিবাচকতার পরের অধ্যায়ে আল্লাহ ভালো কিছু ফায়সালা করে রেখেছেন- এ চেতনাটি মুসলিম হিসেবে আমাদের সকলের লালন করা উচিত।
আল্লাহ তাআলা উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশার রা. বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, “তোমরা একে নিজেদের জন্যে খারাপ মনে করো না; বরং এটা তোমাদের জন্যে মঙ্গলজনক।” (সুরা আন নূর: আয়াত ১১)।
এ আয়াতের মর্মকথার আলোকে আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে, চুড়ান্ত বিজয় অবশ্যই মুসলিমদের হবে।কষ্ট আর বিপর্যয় আমরা কারো জন্যই কামনা করি না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমরা সুসময়ের চেয়ে বরং দু:সময়ে নিজেদের নিয়ে বেশি অনুতপ্ত হই, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরিতে বেশি তৎপর হই।
আমাদের সবার মধ্যে উম্মাতীয় চেতনা নিয়ে যে উদাসীনতা তৈরি হয়েছে, উম্মতের অভ্যন্তরে সংহতির বিষয়ে আমরা এখন যতটা অসচেতন, ফিলিস্তিনের এ ঘটনাগুলো আমাদেরকে আবার ঐকবদ্ধ করবে ইনশাআল্লাহ।ক্রাইসিসের মধ্য থেকেই নেতা তৈরি হয়। এটি ঐতিহাসিকভাবেও প্রমাণিত।
সালাউদ্দিন আইউবি আসার জন্যে আবার একটি পরীক্ষার সময় পার করতে হয়। তখনও কয়েকশ বছর সময় লেগেছিল। তাছাড়া, একজন সালাউদ্দিন সুসময় থেকে জন্ম নেয় না। তারা ফিলিস্তিনিদেরকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করতে চাইছে, এই ছাই থেকেই ফিনিক্স পাখির মতো অচিরেই মুক্ত করার মতো নেতা চলে আসবেন ইনশাআল্লাহ।
আমরা বড্ড বেশি বৈষয়িক ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিলাম। আমরা জীবনের অগ্রাধিকার তালিকা করতেও ভুল করছি। নিজেদের চিন্তা আর ভালো থাকাকে সবাই প্রায়োরিটি দিচ্ছি। আমাদের বেশিরভাগের ঈমানের লেভেল সমতল পর্যায়ে নেমে এসেছে।
ফিলিস্তিনের এই ঘটনাপ্রবাহ আমাদেরকে ভাবাচ্ছে। আমরা যেন নিজেদের ভাই-বোনদের করুণ পরিণতি, নিজের দেশের করুণ দশা নিয়ে সচেতন হই। ফিলিস্তিনকে যেমন মুক্ত করতে হবে তেমনি আমাদের পরিণতিও যেন ফিলিস্তিনের মতো না হয় সে ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে।
ফিলিস্তিনের এই ঘটনা আমাদের সামনে মুনাফিকদের আধুনিক সংস্করনের চেহারা উম্মোচিত করেছে। যারা অবৈধ জায়নবাদী প্রশাসনকে সমর্থন দিচ্ছে সেই আরব মুনাফিকদের বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। যারা নিজেদের চেয়ার ধরে রাখার স্বার্থে পেট্রোডলারের বিনিময়ে মুসলিমদের সামষ্টিক স্বার্থকে বিসর্জন দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার হতে হবে।
আব্দুল্লাহ বিন উবাই আজ আর নেই। কিন্তু তার বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকারী আজও পৃথিবীতে বহাল তবিয়তে বিদ্যমান।আল্লাহ বিপর্যয় দেন, মুনাফিক আর অপবিত্র ব্যক্তিদের থেকে তাইয়্যেবদের আলাদা করার জন্য। ফিলিস্তিনি ভাইয়েরা তাইয়্যেব হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন।
আমরা যেন তাদের সাথে থাকি। আমরা যেন দুনিয়াবি স্বার্থে সমস্যাযুক্তদের সাথে মিলে না যাই। যদি আমরা এ দুনিয়ায় সফলতা পাই, আলহামদুলিল্লাহ। যদি না পাই তাহলেও হতাশ হওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটবর্তী।নিষ্ক্রিয়তার কোনো সুযোগ নেই।
ওখানে যেতে পারছেন না তাই কিছু করার নাই- এমনটা ভেবে অলস বসে থাকবেন না। সক্রিয় হোন। অন্তর সক্রিয় করুন। ঈমানকে আমলে পরিণত করুন। জিহ্বাকে সক্রিয় করুন। কলম দিয়ে লিখে তাদের পাশে থাকুন। সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে জালিমের বিপক্ষে আর মজলুমের পক্ষে সরব হোন। আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্য করুন। আমিন।লেখাঃ Ali Ahmad Mabrur