আধুনিক জীবনে বিস্ময়কর ভূমিকা পালন করে কম্পিউটার যার সাথে আমরা ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে আছি। কম্পিউটারের আবিষ্কার যেন আমাদের জীবনকে আরও সহজ থেকে সহজতর করে তুলতে সাহায্য করছে।
কম্পিউটার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাতেই আমাদের আজকের লেখা।
কম্পিউটার কি?
আধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্র হিসেবে কম্পিউটার বেশ পরিচিত। কম্পিউটার অর্থ গণনাকারী যন্ত্র। এটি গ্রিক শব্দ কম্পিউট (compute) থেকে এসেছে যার অর্থ হিসাব বা গণনা করা।
কম্পিউটার যা আমাদের নির্দেশ মোতাবেক দ্রুতগতিতে নানা ধরনের হিসাব নিকাশের কাজগুলো অতন্ত্য নির্ভুলভাবে করে থাকে। এছাড়াও যেকোন তথ্য গ্রহণ এবং তা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে।
কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস ও জনক সম্পর্কে জানেন কি?
কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস শুরু হয় প্রাচীনকাল থেকে, তখনকার মানুষ গণনার জন্যে নুড়ি, পাথর, কাঠি ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করত। পরবর্তীতে এর বিকল্প হিসেবে আসে অ্যাবাকাস (ABACUS)। একটি ফ্রেমে সাজানো পুথি সরিয়ে গণনা করা সহ বিভিন্ন ধরনের গাণিতিক হিসাব নিকাশ করার জন্য খ্রিস্ট ৪৫০/৫০০ অব্দে চীনে প্রথম অ্যাবাকাস যন্ত্র আবিষ্কার হয়। একেই ইতিহাসের প্রথম গণনাকারী যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়।
এরপর ১৬১৬ সালে স্কটল্যান্ডের গণিতবিদ জন নেপিয়ার গণনার জন্যে দাগকাটা পদ্ধতি ব্যবহার করে। যেটা নেপিয়ারের অস্থি হিসেবে পরিচিত ছিল।
১৬৪২ সালে ব্লেইজ প্যাসকেল নামক ১৯ বছর বয়সী এক ফরাসি বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন। এটাতে শুধুমাত্র যোগ ও বিয়োগের কাজ করা যেত।
এরপর জার্মান গণিতবিদ গটফ্রাইড ভন লিবনিজ ১৬৭১ সালে প্যাসকেলের তৈরি যন্ত্রের ভিত্তিতে আরো উন্নত মানের ক্ষমতাসম্পন্ন গুণ ও ভাগ করার যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর তৈরি করেন। যার নাম ছিল রিকোনিং যন্ত্র (Reckoning machine)।
রিকোনিং যন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা গুলো পরিমার্জন করে টমাস ডি কোমার ১৮২০ সালে লিবনিজের যন্ত্র তৈরি করেন।
এরপরেই আসে ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী চার্লস ব্যাবেজ, উনিশ শতকের শুরুর দিকে অর্থাৎ ১৮২৩ সালে তিনি ডিফারেন্স ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন যেটা যান্ত্রিকভাবে অর্থাৎ কোনো রকম বুদ্ধিমত্তা ছাড়াই গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে পারত। এ সিস্টেমকে তিনি আরও উন্নত করতে থাকেন এবং ১৮৩৩ সালে অ্যানালাইটিকাল ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন।
যেটার সাথে বর্তমান কম্পিউটারের ইনপুট, আউটপুট ও প্রসেসিং এর মিল পাওয়া যায়। এজন্যে চার্লস ব্যাবেজকে কম্পিউটারের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু তিনি বিভিন্ন সমস্যার কারনে এ কাজটি শেষ করতে পারেননি।
এরপর ১৯৪৪ সালে কোন ভ্যাকুয়াম ভালব ছাড়াই সম্পূর্ণ তড়িৎযান্ত্রিক রিলের উপর ভিত্তি করে Mark-1 বা মার্ক-১ কম্পিউটার নামক একটি বিশাল আকৃতির কম্পিউটার নির্মিত হয়। যা আবিষ্কার করেন হাওয়ার্ড আইকেন। চার্লস ব্যাবেজের অসমাপ্ত কাজের বাস্তবায়ন এতে দেখা যায়। এর মাধ্যমেই প্রথম স্বয়ংক্রিয় গণনাযন্ত্র হিসেবে কম্পিউটারের যাত্রা শুরু হয়।
পরবর্তীতে হাঙ্গেরীয় গণিতবিদ জন ভন নিউম্যান সংরক্ষিত প্রোগ্রামের ধারণা দেয়। যার ভিত্তিতে এডভ্যাক (EDVAC) কম্পিউটার তৈরি হয়। তার প্রস্তাবিত বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি ও ডাটা সংকেত মজুদ করার প্রোগ্রামের ধারণাকে আধুনিক কম্পিউটারে ব্যবহার করা হয়। এজন্য ভন নিউম্যানকে আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলা হয়।
আধুনিক কম্পিউটারের বিকাশ ঘটতে শুরু করে বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে। ১৯৭১ সালে মাইক্রোপ্রসেসর উদ্ভাবনের ফলে বাজারে আসে মাইক্রো কম্পিউটার। এর ফলে আগের বিশালাকৃতির কম্পিউটারকে সহজেই ছোট আকৃতির কম্পিউটারে পরিনত করা সম্ভব হয়। মাইক্রোপ্রসেসরের আগমনে বিভিন্ন ধরনের পার্সোনাল কম্পিউটারের বা পিসির উদ্ভব হয়। সেসাথে উদ্ভাবিত হয় নানা ধরনের অপারেটিং সিস্টেম (Linux, windows, windows 7, macos, windows 10), প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ (HTML, java, C, C++, PHP) এবং প্যাকেজ প্রোগ্রামের।
বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটার আসে ১৯৬৪ সালে এবং ধাপে ধাপে ভ্যাকিউম টিউব কম্পিউটার থেকে মাইক্রো কম্পিউটার, লেপটপ এমনকি সুপার কম্পিউটার আসে। এর মাধ্যমে মেশিন ল্যাংগুয়েজ পরিবর্তে হাই লেভেলের ল্যাংগুয়েজে খুব সহজেই প্রোগ্রাম লিখতে ও তৈরি করতে পারি।এছাড়া বিভিন্ন সফটওয়্যার ও এপ্লিকেশন ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা কম্পিউটারের সাহায্য কাজ করতে পারি।
কম্পিউটার কি কি কাজে ব্যবহৃত হয়?
কম্পিউটার শুধু হিসাবনিকাশের কাজের জন্যেই সীমাবদ্ধ নয় বর্তমানে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো ক্রমশ বেড়েই চলছে। জীবনকে সহজ করতে সবধরনের কাজে কম্পিউটার ব্যবহৃত হচ্ছে।
বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে আামাদেরকে অনেক বেশি কম্পিউটারের উপর নির্ভর হতে হচ্ছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, গবেষণা, সংবাদপত্র, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, প্রকাশনা, বিনোদন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র গুলোতে এর ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। কাজকে আমাদের কাছে সহজ করে তুলতে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করছে এই কম্পিউটার।
আরও রয়েছে – আইন সেবা, প্রতিরক্ষা, শিল্প কলকারখানা, আবহাওয়া, ই-কমার্স, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের থেকে আয়, প্রোগ্রাম তৈরি, অনলাইন ব্যবসা, তথ্য আদান-প্রদান ইত্যাদি নানা ধরনের সেবা প্রদান করে থাকে কম্পিউটার।
প্রযুক্তির বিস্ময়কর আবিষ্কার এই কম্পিউটার। কম্পিউটারের ব্যবহারের কথা চিন্তা করলে আপনি বুঝতে পারবেন এটি আমাদের জীবনের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে এটি অতুলনীয় ভূমিকা পালন করছে।
কম্পিউটার আমাদের কি কি উপকার করে?
কম্পিউটারের মতো বিষ্ময়কর আবিষ্কারের ফলে আমাদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। কম্পিউটারের উপকারিতা গুলো সম্পর্কে আপনি জানলে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন।
ব্যবহারের বহুমুখীতাঃ
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটারের ব্যবহার থেকে আমরা এর উপকারিতা সম্পর্কে সহজেই বুঝতে পারি। বর্তমানে এর ব্যবহারের প্রসার দিন দিন বেড়েই চলছে। গাণিতিক সমস্যা সহ এখন এটি বিভিন্ন কাজে আমাদের সাহায্য করছে।
নির্ভুলতাঃ
কম্পিউটার দ্বারা আপনি খুব সহজে যেকোনো গাণিতিক সমস্যার নির্ভুল সমাধান পাবেন। এটি আপনাকে যেকোন ক্যালকুলেশনের ১০০% সমাধান দেয়ার সক্ষমতা রাখে। ফলে সঠিক ভাবে সমাধান পেতে কম্পিউটারের নির্ভুলতা আমাদের অনেক উপকার করে থাকে।
দ্রুতগতিসম্পন্নঃ
কম্পিউটার বেশ দ্রুততার সাথে বিশাল পরিমান ডাটা নিয়ে তার সমাধান করতে পারে নিমেষেই। যেসব গাণিতিক সমস্যাগুলো মানুষকে দিয়ে করতে মাসের পর মাস লাগে সেসব সমস্যাগুলো কম্পিউটার এখন এক নিমেষেই করে দিচ্ছে। যার ফলে আমাদের জীবন হয়ে উঠছে আরও সহজ ও সুন্দর।
ক্লান্তিহীনতাঃ
কম্পিউটার কখনও ক্লান্তি বা একঘেয়েমিতা প্রকাশ করে না। এটি আপনাকে নির্ভুল সমাধান দিতে এর স্পিড বা এ্যাকুরিসির ঘাটতি দেখা যায় না। ফলে আপনার দেয়া তথ্য যদি সঠিকভাবে কম্পিউটারকে দেয়া হয় তবে এর থেকে কখনওই আপনাকে error দেখাবে না।
ডাটা সংরক্ষণঃ
কম্পিউটারের ডাটা ধারণ করার ক্ষমতা মানুষের চেয়ে হাজারগুন বেশি। কম্পিউটারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলতে গেলে মেমোরি বা স্মৃতি ধারণ করে রাখা। যা আমাদের সাহায্য করছে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করতে।
স্বয়ংক্রিয়ঃ
কম্পিউটার আমাদের নির্দেশমোতাবেক তার যেকোনো কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে করার সক্ষমতা রাখে। তথ্য প্রদান করা থাকলে কম্পিউটার নিজ থেকে সে সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে সহজে। এ কারণে আমরা যেকোনো কঠিন কাজও কম্পিউটার দিয়ে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
কম্পিউটারের কি কোন অপকারিতা আছে?
প্রতিটি জিনিসের যেমন ইতিবাচক কিছু দিক থাকে তেমনি কিছু নেতিবাচক দিকও থাকে। কম্পিউটারের কারণে কিছু সমস্যা দেখা দেয় চলুন জেনে আসি এমনই কিছু সমস্যার কথা –
অসুস্থতাঃ
দীর্ঘসময় কম্পিউটারে কাজ করার ফলে চোখ ব্যাথা, ঘাড়ের পেশিতে টান, মস্তিষ্কের ক্ষতিসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। তাই এসব অসুস্থতা থেকে নিজেকে সুস্থ রাখতে কম্পিউটার ব্যবহারের সময় ৩০ মিনিট অন্তর বিশ্রাম নেয়া উচিত। না হলে এসব ছোট সমস্যাগুলো থেকে পরবর্তীতে আপনাকে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
সময় ও শক্তির অপচয়ঃ
বর্তমানে আমরা সোশ্যাল মিডিয়া (যেমন- ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার ইত্যাদি) , গেমস বা অন্য বিনোদনমূলক কাজ গুলোতে অনেক বেশি সময় ও শক্তি অপচয় করে থাকি। দিনের বেশির ভাগ সময়ই আমরা এসব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখি তা যেমন আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তেমনি এর ফলে সামাজিক জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ক্রাইমঃ
কম্পিউটারের এই অসাধারণ কাজ করার ক্ষমতাকে কিছু মানুষ নেতিবাচক কাজ গুলোর জন্যে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গুলো থেকে তথ্য চুরি সহ যে কোন কিছুর আইডি হ্যাক করে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে এর মাধ্যমে।
বেকারত্বঃ
আগে হাজার হাজার মানুষদের দিয়ে যে কাজগুলো করানো লাগতো সেসব কাজগুলো এখন কম্পিউটার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ফলে মানুষ তাদের উপার্জনের উৎস হারিয়ে ফেলছে। এছাড়া কম্পিউটার শিক্ষা না থাকার কারণে মানুষ চাকরি পাচ্ছে না। যার ফলে দিন দিন বেকারত্বের পরিমাণ বাড়ছে।
ব্যয়বহুলঃ
কম্পিউটার এখনো মানুষ কাছে ব্যয়বহুলই বলা চলে। কম্পিউটার প্রতিনিয়ত আপডেট হচ্ছে সেইসাথে চলতে গেলে এর খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বেশ খরচ করতে হয় যার ফলে এটি ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।
শেষ কথা
কম্পিউটার আবিষ্কারের পর থেকে আমরা অনেক বেশি প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছি। এর উপকারী দিকগুলো যেমন আমাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ তেমনি অপকারি দিকগুলো হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠছে।
তাই আমাদের উচিত নেতিবাচক দিকগুলোকে পরিহার করে কম্পিউটারের ইতিবাচক দিকগুলোকে নিয়ে জীবনকে সাজিয়ে তোলা ও সহজ করা।