শহীদ শায়খ ইজ্জুদ্দীন আল- কাসসাম রাহ: একজন সিরীয় আলেম, কৌশলী যোদ্ধা

কে এই কাসসাম, যাঁর স্মরণে হামাস তাদের সামরিক শাখার নাম রাখলো….হামাস, যার পূর্ণরূপ হচ্ছে – حركة المقاومة الاسلامية – ‘হারাকাতু মুকাওয়ামাতিল ইসলামিয়্যাহ’, (ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন)। ১৯৮৭সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন শায়খ আহমদ ইয়াসিন রাহ:।

২০০৪সালে তিনি ইসরাইলি বাহিনীর বিমান হামলায় শহীদ হন, এরপরে দলটির প্রধান হন ডক্টর আব্দুল আযীয রানতিসি। তিনিও কয়েকদিন পর শহীদ হন। ফিলিস্তিন ব্যাপী তাদের কর্ম বিস্তৃত, পুরো গাযা এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে। তাদেরকে ফিলিস্তিনের ইখওয়ান বলা হয়, বর্তমানে দলটির প্রধান ইসমাঈল হানিয়া, এছাড়া খালেদ মিশাল এবং মাহমুদ জিহার তাদের উল্লেখযোগ্য নেতা।

এই হামাসের সামরিক শাখার নাম হচ্ছে ‘কাতায়িবু ইযযিদ্দীন আল-কাসসাম’ (ইজ্জুদ্দীন কাসসাম ব্রিগেড)।.এই নামের সাথে জড়িয়ে আছে একটি ইতিহাস। এই ইতিহাসই হচ্ছেন শায়খ শহীদ ইযযুদ্দীন আল-কাসসাম রাহঃ। তাঁর নামেই মূলত এই শাখার নাম।

জায়নবাদী ইয়াহুদিরা যখন বৃটেনের ছত্র ছায়ার পূর্ণ ফিলিস্তিন দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে বিভিন্ন চক্রান্ত ও গুপ্তহত্যা শুরু করে, তখন সিরীয় এ আলেম তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জি হা দ শুরু করেন।.শহীদ শায়খ ইজ্জুদ্দীন আল- কাসসাম রাহ: একজন সিরীয় আলেম, মু জা হি দ, সফল দাঈ এবং সংগঠক। ১৮৮৩ সালে সিরিয়ার লাতাকিয়া প্রদেশের জাবালাহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পরিবার একটি দ্বীনদার সুপরিচিত ইলমি পরিবার ছিলো। দীনি ও ইলমি পরিবারেই তিনি বেড়ে উঠেন। ১৮৯৬ সালে চৌদ্দ বছর বয়েসে তিনি জামেয়া আযহারে ইলম অর্জনের জন্যে যান, সেখানে ধারাবাহিক দশ বছর অধ্যয়নের পর ১৯০৬ সালে নিজে শহর জাবালাহে চলে আসেন। সেখানে শিক্ষক ও খতীব হিসেবে জামে ইবরাহীম বিন আদহাম মসজিদে কর্ম শুরু করেন।

একজন যোগ্য ইমাম, খতীব এবং শিক্ষক হওয়ার দরুন আশপাশের অনেক লোক তার ভক্ত-অনুরক্ত হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘মহান আল্লাহ একটি জাতির ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরা পরিবর্তিত হয়। অতএব তোমরা সম্মানি আত্মমর্যাদাশীল হও, সম্মান হচ্ছে আল্লাহর জন্যে, রাসূলের জন্যে, মুমিনের জন্যে, সে প্রকৃত মুমিন নয় যে লাঞ্ছনায় সন্তুষ্ট হয়, জুলুমের সামনে নতি স্বীকার করে এবং মানুষের দাসত্ব করাকে মেনে নেয়।’

.১৯১১ সালে যখন ইটালি লিবিয়ায় হামলা করে, তখন তিনি তাঁর স্থানীয় জনগণকে লিবিয়ার জি হা দে শরীক হওয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন, শতাধিক যুবককে তিনি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন, পরে জাহাজ না পাওয়ায় তাদের লিবিয়া যাওয়া হয় নি, বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, তিনি নিজে গোপনভাবে লিবিয়ার রণভূমি পরিদর্শন করে আসেন এবং শায়খুল মু জা হি দী ন উমর আল-মুখতার রাহঃ’র সাথে সাক্ষাৎ করেন।.

১ম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খিলাফতের পরাজয়ের পর ১৯১৮ সালে যখন ফ্রান্স বাহিনী সিরিয়া হামলা করে, তখন ফ্রান্স বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন, তিনি তাঁর ঘর বিক্রি করে জিহাদের জন্যে অস্ত্র কিনেন, তিনি বলতেন,ليس المهم أن ننتصر، المهم قبل كل شيء أن نعطي من أنفسنا الدرس للأمة والأجيال القادمة ‘এটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যে আমরা বিজয়ী হবো, আমাদের কাছে সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই উম্মতকে এবং আগামী প্রজন্মকে আমরা শিক্ষা দিয়ে যাবো’।

এ লক্ষ্যে একটি গেরিলাবাহিনী গঠন করেন, তিনি জি হা দে র জন্যে শহর-গ্রাম ছেড়ে সিহউন পাহাড়ে আশ্রয় নেন। ফ্রান্সবাহিনীর বিভিন্ন সামরিক ঘাটিতেও তিনি হামলা চালান। তখন ফ্রান্সবাহিনী তাঁকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে লড়াই থেকে নিবৃত্ত রাখতে চায়।

তারা সন্ধির নামে এক দূতকে তাঁর কাছে পাঠায়, ওই দূত তাঁর কাছে শরয়ি কাযী হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে যায়, তখন তিনি এই দূতকে বলেন, ফিরে যাও, আর এসব দখলদারকে বলে দিও, ‘আমি জি হা দ থেকে বিরত থাকবো না, যতক্ষণ না আল্লাহর সাথে শহীদ হয়ে সাক্ষাৎ করি’।তাঁর সাড়াশি আক্রমণে ফ্রান্স বাহিনী দিশেহারা হয়ে গ্রামের সাধারণ জনতার উপর গণহত্যা শুরু করে, বেসামরিক লোকদের ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়।

দখলদার বাহিনী তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে এবং তার ঠিকানা সন্ধানদাতার জন্যে ১০ হাজার সিরীয় মুদ্রা (লীরা) ঘোষণা করে। বেসামরিক জনতার নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি লাতাকিয়া ছেড়ে দামেশকে চলে যান, সেখান থেকে তিনি বর্তমানে ইসরাইল অধিকৃত হাইফায় চলে যান, তাঁর বাহিনীসহ। .ওই সময় ফিলিস্তিন এলাকা ছিলো বৃটেনের দখলে, তখন বৃটেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইয়াহুদীদেরকে ফিলিস্তিনে নিয়ে আসা শুরু করে, জায়নবাদীদের সাথে তাদের চুক্তি হয়।

তখন শায়খ কাসসাম হাইফার জনগণকে ব্রিটিশ চক্রান্তের ব্যাপারে সতর্ক করা শুরু করেন, জি হা দের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। কাসসামিয়া নামে একটি গেরিলা বাহিনীও গঠন করেন। তিনি বিভিন্ন জাতীয়-আন্তর্জাতিক সংস্থার কথিত আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন, বৃটেনের আনুগত্য করা যাবে না বলে জনগণকে উদ্বুগ্ধ করেন।

১৯৩৪ সালে একবার কাসসাম মসজিদের মিম্বর থেকে মুসল্লীদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি মুসলমান? এরপর তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি না, যদি তোমরা মুমিন হতে তাহলে তোমাদের আত্মমর্যাদা থাকতো, আর মসজিদ থেকে বের হয়ে তোমরা কোনো ব্রিটিশ সৈন্যের আনুগত্যে করতে না। তিনি বার বার সতর্ক করে বলেন, ‘ইয়াহুদীরা তোমাদের উচ্ছেদ করার সুযোগ খুঁজতেছে, তারা তোমাদেরকে তাড়িয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়’।

তিনি সময় থাকতে ফিলিস্তিনবাসীকে সজাগ হতে আহবান করেন। তিনি সবাইকে অস্ত্র কেনার জন্যে আহবান করেন, এবং বলেন, বর্তমানে হজ্বে না গিয়ে হজ্বের টাকা দিয়ে অস্ত্র কেনা হউক।

অবশেষে তিনি অত্যন্ত গোপনভাবে সতর্কতার সাথে তাঁর কাসসামিয়া বাহিনীতে সদস্য রিক্রুট করা শুরু করেন, তাদের শ্লোগান ছিলো, ‘هذا جهاد نصر أو استشهاد’ (এটা জি হা দ, যার লক্ষ্য বিজয় বা শাহাদাহ)।তিনি জি হা দের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে অনেক রাষ্ট্রপ্রধান ও উলামার সাথে যোগাযোগ করেন। কেউ কেউ তাঁকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সাহায্য করে নি, আবার কেউ কেউ বলে, আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করা হবে। তবে অল্প সংখ্যক লোক তাঁর আহবানে সাড়া দেয়।

এদিকে ইয়াহুদী শরণার্থীদের সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছিলো।. অবশেষে ১৯৩৫ সালে তিনি প্রকাশ্যে বৃটেনের বিরুদ্ধে জি হা দ শুরু করেন। এলক্ষ্যে তিনি হাইফার পল্লী এলাকায় চলে যান। ব্রিটেনের বিরুদ্ধে অনেক সফল অভিযান পরিচালনা করেন। পরে ১৯৩৫ সালের ২০ নভেম্বর হাইফার নাযলাহ শায়খ যায়দ এলাকায় ব্রিটিশ ও দেশীয় পুতুল পুলিশের সাথে একটি অসম সম্মুখযুদ্ধে তিনি তিনজন সাথীসহ শাহাদত বরণ করেন।

ভোর থেকে শুরু করে আসরের পূর্ব পর্যন্ত এ লড়াই চলে। মৃত্যুর পুর্বে তাকে পুলিশ বাহিনী ঘেরাও করে ফেলে এবং বলে আত্মসমপর্ণন করো ‘বেঁচে যাবে,’ জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা কখনো আত্মসমর্পণ করবো না, এটা আল্লাহর রাহে জি হা দ’। এরপর সাথীদেরকে বলেন, ‘শহীদ হয়ে মৃত্যুবরণ করো’! জবাবে তারা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে শ্লোগান দেয়। তিনি ও তাঁর তিন সাথী শহীদ হন, তাঁর অনেক সাথী গ্রেফতার হয়।

এ লড়াইকে ইয়া’বুদের লড়াই বলা হয়। মৃত্যুর পর তাঁর কাছে একটি কুরআন শরীফ ও চারটি মুদ্রা পাওয়া যায়। বলা হয়, তিনি হাইফা শহর ত্যাগ করার পূর্বেই তিনি তাঁর ঘর বিক্রি করে বের হন।ফিলিস্তিন রক্ষার জন্যে তাঁর নেতৃত্বেই সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।

তাঁর এই শাহাদত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চরম প্রভাব ফেলে, যার ফল হচ্ছে আজকে ‘ইজ্জুদ্দীন কাসসাম ব্রিগেড’, কাসসাম রকেট’!.তাঁর জীবনী বিভিন্ন মাধ্যমে পড়লেও বর্তমান লেখাটি উইকিপিডিয়া আরবিকে সামনে রেখে সাজানো হয়েছে।

  • লেখক আব্দুল্লাহ মায়মুন

Leave a Comment